গান থামালেন অজিত পাণ্ডে
নিজস্ব প্রতিনিধি
কলকাতা, ১৩ই জুন — চলে গেলেন কমরেড অজিত পাণ্ডে। হাটে-মাঠে-ঘাটে অক্লান্ত গান গেয়ে যাওয়া বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের জীবনাবসান হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। সকালে কালিকাপুর অহল্যানগরের বাড়িতে প্রতিদিনের মতো বাইরের ঘরে বসে চা খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ঘড়িতে তখন ৯-১০ মিনিট। পাশেই ছিলেন স্ত্রী ও ছেলে। চিকিৎসার কোনো সুযোগই মেলেনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৫। রেখে গেলেন স্ত্রী গায়ত্রী পাণ্ডে, একমাত্র ছেলে অগ্নি পাণ্ডে সহ অসংখ্য গুণমুগ্ধদের।
তাঁর মৃত্যু সংবাদে বাড়িতে ছুটে আসেন সি পি আই (এম) নেতা রবীন দেব, কান্তি গাঙ্গুলি, রমলা চক্রবর্তী সহ অনেকেই। শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁরা। এছাড়া শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যান গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, গণনাট্য সঙ্ঘের পক্ষে তরুণ গুপ্ত, বেণু চট্টোপাধ্যায়সহ শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীত জগতের অসংখ্য মানুষ।
অজিত পাণ্ডের জীবনাবসানে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিমান বসু এদিন গভীর শোক জানিয়ে বলেন, অজিত পাণ্ডেকে বহু বছর ধরে চিনতাম। কেশোরাম রেয়নের একজন শ্রমিক থেকে তিনি গণসঙ্গীতের প্রশস্ত অঙ্গনে এসে বহুদিন সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। আবার আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিতও হয়েছেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের চারণকবি। চাসনালার শ্রমিকের জীবনযন্ত্রণা মূর্ত হয়ে উঠেছিল এই চারণকবির গলায়। ভিয়েতনামের বুকে সাম্রাজ্যবাদী অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। তিনি একবার বিধায়ক হয়েছিলেন। বিধায়ক হওয়ার পরেও তাঁর জীবনচর্যার কোনও পরিবর্তন হয়নি। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে অজিত পাণ্ডে গণসঙ্গীতের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনকে পুষ্ট করেছেন। তাঁর চলে যাওয়ার ফলে গণসঙ্গীত ও গণ-আন্দোলনের ক্ষতি হলো। আমি তাঁর ছেলে অগ্নি পাণ্ডে ও পরিবার-পরিজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, অজিত পাণ্ডে ভীষণ জনপ্রিয় একজন শিল্পী ছিলেন। পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপযোগী গান বাছার একটা অদ্ভুত দক্ষতা ছিল তাঁর। খুবই পরিশ্রমী শিল্পী ছিলেন। প্রয়োজনে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে পারতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে, গরিব মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে যেতে পারতেন। তিনি সঙ্গীতচর্চা করেছেন, আবার প্রত্যক্ষ রাজনীতিও করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হলো। প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা বিনয় কোঙার শোক জানিয়ে বলেন, ছয়ের দশক থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই সময় মেমারিতে পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচীতে তিনি গণসঙ্গীত পরিবেশন করতে এসেছিলেন। তাঁর গলায় ‘ও নুরুলের মা’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর পরিবারের সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা রইলো।
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অনুনয় চট্টোপাধ্যায় ও ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন এক শোকবার্তায় বলেন, বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের জীবনাবসানে আমরা শোকস্তব্ধ। লেখক শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। বামপন্থী ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন এবং আজীবন তাঁকে বহমান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের রাজ্য কমিটি। পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক মুজফ্ফর হোসেন অজিত পাণ্ডের মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করেন।
বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সৈনিক প্রয়াত শিল্পী ছিলেন সি পি আই (এম)-র সদস্য। ১৯৯৮ সালে কলকাতার বউবাজার বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তিনি বামফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। বিধায়ক হিসেবে ছিলেন ২০০১ সালের মে মাস পর্যন্ত।
অঙ্গীকার করেছিলেন মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদানের। সেই কথা মতো এদিন দুপুর ২টা নাগাদ শঙ্কর নেত্রালয়ের সদস্যরা আসেন বাড়িতে। স্ত্রী, ছেলে সহ অসংখ্য আত্মীয়রা তখন হাজির। ওঁরা চক্ষু সংগ্রহ করার পরই পরবর্তী কর্মসূচী স্থির হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলেই প্রয়াত শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বউবাজার থানার বো স্ট্রিটের ‘মাদেরা’ দেহ সংরক্ষণ কেন্দ্রে। এখানেই থাকবে মরদেহ। শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ মরদেহ আনা হবে কালিকাপুর অহল্যানগরের শিল্পীর বাসভবনে। এখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সি পি আই (এম) রাজ্য দপ্তরে। এখানেই শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন রাজ্য নেতৃবৃন্দ সহ বিভিন্ন গণসংগঠন ও সাধারণ মানুষ। এরপর মরদেহ বিধানসভা ভবন হয়ে পৌঁছবে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওখানেই মরদেহ তুলে দেওয়া হবে কর্তৃপক্ষের হাতে।
অজিত পাণ্ডের মৃত্যুতে শোকাহত মুর্শিদাবাদ। তাঁর জন্মভূমি লালগোলাও শোকস্তব্ধ। জেলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, গণআন্দোলনের কর্মীরাও শোকাহত। সি পি আই (এম) মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শোকবার্তায় বলেন, রাজ্যের এক কঠিন সময়ে অজিত পাণ্ডের মতো একজন মানুষের মৃত্যু গণআন্দোলনের কর্মীদের কাছেও বড় বেদনার। তিনি তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানান।
শোক জানিয়ে শিল্পী শুভেন্দু মাইতি বলেছেন, নানা সঙ্কট, বিপদের মধ্যেও বামপন্থার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন সারা জীবন। মানুষের লড়াইকে শ্রদ্ধা করতেন অজিত পাণ্ডে। তাই লড়াইয়ের ময়দানে গান গাইতে ডাকলে না করতেন না। অসুস্থ শরীরেও ছুটে যেতেন। তাঁর চাসনালার গান তো ইতিহাস হয়ে আছে। এছাড়া লালনের গানকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে গাইতেন। শোনাতেন লোকসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের গান। ওঁর পরিবেশনের ঢঙটাই ছিল অন্যরকম। গীতিকার নন্দদুলাল আচার্য বলেন, আমার লেখা অনেকগুলি গানে উনি সুর করে গেয়েছেন। অনবদ্য সে সুর আর পরিবেশন। একা মানুষ মঞ্চ দখল করে রাখতেন অনেক সময়। এই জন্যই তিনি ব্যতিক্রমী শিল্পী, ব্যতিক্রমী মানুষ। সংগ্রাম থেকে কখনো পিছু ফেরেননি।
তাঁর কথা: মানুষের লড়াইয়ের শরিক ছিলেন সারাটা জীবন। সে লড়াইয়ের হাতিয়ার ছিল গান। বরাবরই চাইতেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে গান শোনাতে। পরোয়া করতেন না, যারা গান গাইতে দেয় না তাদের। কখনো রাজনৈতিক মঞ্চ, কখনো পাড়ার জলসা, কখনো খনি এলাকার মানুষজনের সামনে গান গেয়েছেন উদাত্ত কণ্ঠে। বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শরিক ছিলেন আজীবন। ছয়ের দশকে ঝরিয়া, রানীগঞ্জ এলাকার খনি অঞ্চলে বিভিন্ন গণআন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সাথী ছিল গণসঙ্গীত। পরবর্তী সময়ে তারই এক স্ফূরণ দেখা দিয়েছিল ‘চাসনালা খনিতে’ গানটিতে। সেটা সাতের দশক। উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না।’ মঞ্চ কাঁপানো সেইসব গানই শোনা যেতো কখনো শহর, কখনো গ্রামবাংলার বুকে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ কবিতাটি গান হয়ে তাঁর কণ্ঠে পেয়েছিল অন্য মাত্রা।
জন্ম ১৯৩৭ সালের ১০ই মার্চ মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা ছিল। সেই প্রভাব পড়েছিল শিল্পীর মননে। জীবনের সংগ্রামও জড়িয়ে ছিল গান গাওয়ার মতো। বাড়ির অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। ফলে অনেকরকম কাজই করতে হয়েছে। এক সময় হুগলীর বাঁশবেড়িয়ায় কেশোরাম রেয়নের কর্মী ছিলেন। রক্তে যার গান তার কি ভিন্ন পেশা কাজে লাগে? লাগেনি বলেই ছয়ের দশক থেকে নেমে পড়লেন গণসঙ্গীত নিয়ে। জানতেন সেখানে অনেক প্রতিকূলতা, অনেক ঝড়-ঝাপটা, আঘাত; তবুও হার মানেননি। গণসঙ্গীতকেই পরম সাথী করে নেমেছিলেন সংগ্রামের ময়দানে। ছয়ের দশক থেকে সাতের দশকের সেইসব ঝোড়ো দিনে প্রগতির ময়দান থেকে পিছু হটেননি। এর জন্য তাঁকে অনেকবার কারাবরণও করতে হয়েছে। তবুও নতিস্বীকার নয়, সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের মঞ্চে গানই ছিল তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। কয়লা খনি শ্রমিকদের স্বার্থে গান গেয়েছেন, আবার কখনো শোনা গেছে দীনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, নন্দদুলাল আচার্যের কবিতার গান। বেশির ভাগ গানেই সুর দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল ইনরেকো থেকে। তাতে কবিদের কবিতা নিয়ে গান করেছিলেন অজিত পাণ্ডে। তাঁর বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে ‘চাসনালা খনিতে’, ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না’, ‘জারে কাঁপছে আমার গা’, ‘লদী শুখা পুখর শুখা’, ‘দুখু মিঞা হে’, ‘চন্দন পিঁড়ির অহল্যা মা’, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ ‘ও নুরুলের মা’ প্রভৃতি। গীতিকার নন্দদুলাল আচার্যর প্রায় ২০টি গান তিনি সুর করে গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন। গণসঙ্গীতের ধারায় নতুন এক কণ্ঠ। সে কণ্ঠ আর দশজনের মতো নয়। কবিতায় সুরারোপ করে তা মানুষের মাঝে গেয়ে যে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় তার অন্যতম উদাহরণ শিল্পী। বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাক পেলেই ছুটে যেতেন। গণসঙ্গীতকে যে অনেকের কাছে, অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার বড়সড় উদাহরণ তিনি। শুধু গণসঙ্গীত নয়, পাশাপাশি গেয়েছেন লালনের গান, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান। লালনের গানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিলেন। নিয়মিত চর্চাও করতেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘লেনিন’-কে নিয়ে লেখা একটি কবিতার সুরারোপ করে বিপুল প্রশংসা পান। দর্শকরা উদ্বেল হয়েছেন গণসঙ্গীতের সঙ্গে এই ধরনের কবিতার গীতিরূপে।
গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মধ্যে যে অনেক ঝক্কি তা তিনি জানতেন। সময়ে সময়ে পারিশ্রমিকও মিলতো না। বলতেন, মানুষকে অনেক গান শোনাবো তার জন্য সর্বদাই পারিশ্রমিক মানায় না। ছাত্র-যুব আন্দোলন থেকে গণসংগ্রামের পরিধিতে একটা কথা চালু ছিল: কিছুই নেই ফান্ডে/ আছেন অজিত পাণ্ডে। নিজেই মজা করে বলতেন, এই ছন্দটা আমার মোটেই খারাপ লাগে না। ছয়ের দশকে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন ‘নন্দন’ পত্রিকার সঙ্গে। এছাড়া যুক্ত ছিলেন অনেক গণসংগঠনের সঙ্গে। একটা কথা বলতেন, যেখানেই থাকি বামপন্থা হাতছানি দিয়ে ডাকে।
দীর্ঘদিন ছিলেন মলঙ্গা লেনের ছোট্ট বাড়িতে। ২০০৩ সালে বাড়ি করে চলে যান কালিকাপুরের অহল্যানগরে। আমৃত্যু এই বাড়িতেই ছিলেন।
বিভিন্ন সময় পাড়ি দিয়েছেন রাশিয়া, বার্লিন, ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশে গানের সুবাদে। যেখানেই গেছেন জয় করেছেন শ্রোতার হৃদয়।
No comments:
Post a Comment